

করোনার বিরুদ্ধে সমগ্র মানবজাতির এই যুদ্ধে ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়ার নেতৃত্বে প্রস্তুত অসংখ্য মানবিক গল্পে গড়া বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ড হসপিটাল ।
নাম “চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল”।
ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র ফিল্ড হসপিটাল তৈরী করা হয়েছিল।
নাম “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” ।
এই হাসপাতালের গল্পটি ব্যাতিক্রম। চিকিৎসক,নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী সবাই এই হাসপাতালে জীবনবাজি রেখে সেবা দেয়ার ব্রত করে পরিবার ছেড়ে এসেছেন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা নেই । বৃদ্ধ বাবা সন্তানকে উৎসর্গ করলেন মানব সেবায় এমন গল্প আছে, তিন মাসের নতুন সংসার এর মায়া ছেড়ে মানুষের পাশে দাড়ানোর সাহসী গল্পও আছে, আছে দেড় বছরের শিশুকে হয়তোবা শেষ বারের মতো চুমু খেয়ে আসা বাবার গল্পও। আর এইসবকিছুর বিনিময়ে প্রাপ্তি শুধুই মানুষের সেবা করতে পারা। এই হাসপাতালে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা ফ্রি! নেই পারিশ্রমিক বা আর্থিক পুরস্কার। তবে মনের খোড়াক অফুরন্ত তা আমি বলে দিতেই পারি।
এই পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান থেকে মানুষের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করেছি। শুরুতে আমাদের সংগঠন SomeWhereInEarth এর মাধ্যমে মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করি বন্ধু এবং অনুজদের নিয়ে। এরপর অনুভব করি দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল মানুষদের পক্ষে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা সম্ভব নয় এবং ক্ষুধার তাড়নার আগে সুরক্ষার কথা বলা বেমানান।তখন আবার পরিবার এবং বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে 100 টি পরিবারের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করি। ব্যাক্তিগত ভাবে আরো 2 টি পরিবারকে 1 মাস কোনভাবে চলার মতো অর্থ দিয়ে সাহায্য করি। লোকদেখানো আমার উদ্দেশ্য না হলেও আমি মনে করি উৎসাহিত করার জন্য ভালো কাজের প্রকাশ করা উচিৎ । কিন্ত এবারের পরিস্থিতিতে সবার মতামত নিয়ে আমরাও গোপনে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচীর সিদ্ধান্ত নেই । এরপর যখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, একটু ভয়ে ছিলাম, বাসায় রাজি হবে তো?
আমি এখনো ছাত্র, তাই হয়তো সঙ্গত কারণেই বাবাকে যখন জানাই আমার সিদ্ধান্তের কথা, তখন বাবার বক্তব্য ছিলো “তুমি তো নিজ অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব করেছো, আর তুমি মেডিকেল ডিসিপ্লিনের ছাত্রও না , আরেকবার ভেবে দেখো” । মা কে জানানোর পর মায়ের বক্তব্যও ছিলো কাছাকাছি। কিন্ত আমি আসলে জানতাম তারা রাজি হবে, কারণ মানুষকে ভালোবাসার যে নেশা আমার, তা তো তাদের কাছেই শেখা।
জন্মের পর থেকে জানি বাবা ভাত খান না, কারণ একবার দুর্ভিক্ষে তিনি পণ করেছিলেন যতদিন না দেশে আর কেউ ভাতের অভাবে মারা যাবে না, ততদিন তিনি ভাত খাবেন না। তার এই প্রতীকী পণ আজও বলবৎ, ভাত ছুয়ে দেখেন না। মায়ের কথা বলা শুরু করলে তার ইতি আমি টানতে পারবো না আজ। শুধু বলবো “আমার এ ঘর ভাংগিছে যে বা, আমি বাধি তার ঘর” , এই মন্ত্রে বিশ্বাসী আমার মা। তাই তাদের জানানোর আগেই জানতাম আমাকে তাদের যেতে দিতেই হবে। আমরা পুরো পরিবার ই সম্ভবত ইমোশনাল ফুল! and I am proud of that.
কোভিড-19 মহামারী মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সারা বিশ্ব। প্রায় সব দেশেই দেখা দিয়েছে ডাক্তার নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক , নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর ঘটনাও আর নতুন নয়। এই পরিস্থিতেও মানবিক সাহস নিয়ে এগিয়ে আসা প্রতিটি মানুষের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই যুদ্ধে তাদেরই একজন হয়ে মানুষের সেবায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর হতে আজকে সব প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি ছাড়ার আগ পর্যন্ত জমা হয়েছে অসংখ্য সুন্দর গল্প। এই বিষয়ে আমার বিশ্ববিদ্যাল্য় কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে আমার কর্মস্থল, সব জায়গায় পেয়েছি আশাতীত সহযোগীতা। সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আবার কবে বাড়ি ফিরবো বা আদৌ ফিরবো কিনা জানিনা। তবে গল্পগুলো জমা থাকলো, আরও যত নতুন গল্প সব জমা থাকবে। যদি জয়ী হয়ে ফিরি, গল্পগুলো আপনাদের শোনাব, জমা থাকবে ভবিষ্যৎ নাতি পুতিদের জন্য।
পরিশেষে বলতে চাই, আশা বাধতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই যে আমরা সকলে মিলে এই দুর্যোগ থেকে বের হয়ে আসতে পারবো।
আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য এবং চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের সাথে জড়িত সকলের জন্য দোয়া চাই । আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্যও দোয়া রইলো। সবাই নিরাপদে থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।
করোনামুক্ত একটি ভোরের অপেক্ষায়…